Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

সাংস্কৃতিক সংগঠন

ইতিহাস ঐতিহ্যগত দিক দিয়ে থানচি উপজেলার তিন্দু ইউনিয়ন অধিক পরিচিত। এই ইউনিয়নের সাংস্কৃতিমনা অনেক লোক রয়েছে। উল্লেখ যোগ্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো হচ্ছে

১। খুমী সম্প্রদায় সাংস্কৃতিক সংগঠন

 

খূমীপরিচিতিঃ খূমী অর্থ হচ্ছে উঁচু পাহাড়ের মানুষ। ‘খু' অর্থ সীমান্তের উঁচু পাহাড় এবং ‘মী’ অর্থ মানুষ। আদিবাসী খুমী নৃ-জনগোষ্ঠী মূলত মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর্ভক্ত একটি দল। খুমীদের মূল জনগোষ্ঠীর বসবাস আরাকানে। গোষ্ঠীগত দাঙ্গায় খুমীদের একটি অংশ পালিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বান্দরবানের রুমা, থানছি ও রোয়াংছড়ির বিভিন্ন দূর্গম এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে আসছে। খুমী জনগোষ্ঠীর লোকেরা কুকি-চীন ভাষাভাষি দলের অন্তর্ভূক্ত। খুমী জনগোষ্ঠী প্রকৃতিপূজারী। এরা বৌদ্ধ, ক্রামা, খ্রিষ্টান ও প্রকৃতিপূজারী এ চার ধরণের ধর্মানুসারী। তাদের আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ জীবনধারায় ম্রোদের সাথে খুব মিল পাওয়া যায়। আদিবাসী খুমীরা নারী-পুরুষ সবাই লম্বা চুল রাখে। খুমী আদিবাসী লোকজন প্রায় ৪৮টি গোত্রে বিভক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত খুমী সমাজের ৩২টি গোত্রের লোকজন রয়েছে। গোত্র গুলো হচ্ছে- সামথাং, সেওকেবেউ (সুকোবে), উমিং, বুইতিং, পকেন, ওয়ইদাইং, রেমিচ্য, সাংলা, খ্যয়মেই, লাংওয়ইচ্য, লৈমলাউ, আমমাং, সামতুচ্য, বাল উ চ্য, কাই চ্য, ঙোতা চ্যা, মারান চ্য, লেমিচ্য, রাকি চ্যা, প্লাং, দেও খাং, তিংতু, ত্‌লামতা/ত্‌লামমা, রেংমা, খ্যাংসা, বেউলে, ওয়ই চ্ছিং, ওয়ই লাং, নিদিউং, ক্রিমসাং, য়ইলিউং, বেতত্‌লাই চ্যা। অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে, খুমী জনগোষ্ঠীভূক্ত একজন আদিবাসী পুরুষের ঔরসে তাকে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিই খুমী পরিচয়ের অধিকারী। খুমী জাতিসত্বার অন্তর্ভূক্ত কোন পরিবারে জন্মগ্রহণকারী শিশুর সামাজিক পরিচিতি খুমী বলে স্বীকৃত হবে। নিজেকে খুমী হিসেবে পরিচয় দান করে, এরূপ একজন খুমী এর ঔরসে জন্মগ্রহণকারী এবং দত্তক সূত্রে খুমী পরিবারে লালিত সন্তানও খুমী পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করবে। তবে মাতাকে খুমী নারী হতে হবে এমন কোন সামাজিক বাধ্যবাধকতা নেই।

জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহে সামাজিক বাধ্য বাধকতাঃ খুমী জন- গোষ্ঠী জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহে এই তিনটি বিষয়কে সামাজিক ও রীতিনীতি আচার-অনুষ্ঠানের দ্বারায় আবদ্ধ করেছে। এসব রীতিনীতি আচার-অনুষ্ঠান খুমী সমাজ মেনে চলা হয়।

 

শিশুর জন্মশুদ্ধিঃ- খুমী সমাজে কোন পরিবারে শিশু জন্মের দিন ‘আথিক্লো’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শিশু ভূমিষ্ট হবার সময় যে সকল বয়স্ক মহিলা প্রসূতির কাছে থাকে তারা অনুষ্ঠানে অংশ নেন এবং রীতি অনুযায়ী তাদরেকে মদ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। প্রথম সন্তান জন্মের ১৫দিন পর প্রসূতি মাকে লবণ খেতে দেয়া হয়। তিন মাস পর্যন্ত মাছ, মাংস খেতে দেয় না। দ্বিতীয় সন্তানের বেলায় ৭ দির পর লবণ খেতে দেয়। খুমী সমাজের এই নিয়ম তাদের প্রাচীন রীতির অংশ বিশেষ। জন্মের ১ বছর পর জুম কাটা শেষে শিশুর প্রথম চুল কাটা হয়। এ উপলক্ষে পূজার আয়োজন করা হয়। এসময় ৯ টি বাঁশের আগা দিয়ে ঘর সাজানো হয়। চাউলের গুড়া মিশ্রিত পানি শিশুর পায়ে এবং ঘরে ছিটানো হয়ে থাকে। এরপর পশুবলি দিয়ে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে খাওয়ানো হয়। পাড়ার একজন প্রবীণ ব্যক্তি পুজার অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। এসময় বাহুতে সাত/ছয় প্রস্থ সুতা পেঁচিয়ে বেঁধে দিয়ে সন্তানকে এই বলে আশীর্বাদ করে ‘সৌভাগ্যবান হও, সাহসী হও, স্বাস্থবান হও। এ অনুষ্ঠানকে ‘সামলিং ওয়ানা’ বলে। ক্রামা ধর্মাবলম্বী খুমী সমাজে সন্তান ১২ বছরে পদাপর্ণ করলে ‘ফুংতানা’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

 

যৌবনে পদাপর্ণঃ- খুমী সন্তান বা বছরে পা রাখলে পশুবলি দিয়ে পাড়ার মুরুব্বী, ধর্মীয় গুরু, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনদের আপ্যায়ন করা হয়। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরিবারের পক্ষ থেকে সন্তানকে (ছেলে বা মেয়ে) যৌবন প্রাপ্ত হিসেবে সমাজের ঘোষণা দেয়া হয়।

 

বিয়ের রীতিঃ পাত্রের বাবা নিজ গোত্রের গণ্যমান্য কয়েকজনকে নিয়ে ১টি মুরগী, এক বোতল মদ ও ১টি বল্লমসহ পাত্রীর পাড়ায় বা গ্রামে পৌছে রাতের বেলায় একজন ঘটকের সাহায্য পাত্রীর বাবার কাছে মুরগী ও মদ উপঢৌকন পাঠায়। পাত্রীর অভিভাবক প্রস্তাবে সমমত হলে উভয়পক্ষ পানাহারের আসরে বসে বিয়ে সংক্রান্ত আলোচনা করেন। পরদিন সকালে উভয়পক্ষ বিয়ের প্রস্তাব চূড়ান্ত করে পাত্রপক্ষ আনা বল্লমটি দিতে হয় প্রতীকি চিহৃ হিসেবে। আর বিয়েতে সমমতি না হলে বল্লমটি ফেরত নেয়া হয়। বিয়ের সমমতি হলে পাত্রীপক্ষ ১২০টি রৌপ্য মুদ্রা, বেজোড় সংখ্যক ১৯টি মুরগী ও ১৩টি বল্লম পণ পাত্রপক্ষের কাছে দাবী করে। আর পাত্রের জন্য পাত্রীপক্ষ থেকে একটি মাথার পাগড়ী আর শুকর উপঢৌকন দেয়া হয়। কনের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান হয় মদ পরিবেশনের মাধ্যমে। অনুষ্ঠানে মোরগের জিহবা পরীক্ষা করে নবদম্পতির শুভাশুভ যাচাই করা হয়। পাত্র-পাত্রী উভয়পক্ষের মধ্যে তিন দফা খাওয়া-দাওয়া ও মদ পরিবেশন করে আপ্যায়নের মাধ্যমেই বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। অনুষ্ঠানে কনের মামাকে পৃথকভাবে মুরগী রান্না করে সর্বপ্রথম খাওয়াতে হয়। কনেপক্ষের অতিথিদের জন্য মুরগীর মাংস এবং বরপক্ষের অতিথিদের জন্য শুকরের মাংস পরিবেশন করা বাধ্যমূলক। এর অন্যথা হলে জরিমানা দিতে হয়।

 

সৎকার রীতিঃ খুমী সমাজে কারো মৃত্যু সাথে সাথে পরিবারের লোকজন ১টি কুকুর, ২টি মুরগী, ২টি শুকর বধ করে। মৃতর মামা গোগ্রীয় যে কোন ঘরে উঠার সিঁড়িতে লাইয়ের ১টি খোল ‘তুইডিন’ আছড়ে ভেঙ্গে ফেলে, যাতে আর কারো মৃত্যু না হয়। মৃত ব্যক্তিকে ৪/৫/৭দিন পর্যন্ত ঘরে রাখা হয়। লাশ ঘরে থাকা অবস্থায় প্রতিদিন ঢাক-ঢোল ও বিভিন্ন বাধ্য-যন্ত্র বাজানো হয়। গ্রামে বা পাড়ায় অবস্থানকারী মৃতের প্রত্যেক সন্তানের বাড়িতে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর পাড়া বা গ্রামের শেষ সীমানায় মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার পর পাড়ার লোকজন সমবেত হয়ে মৃতের আত্মার শান্তি কামনা করে। শবদাহ করার পর চিতার পাশে নির্মিত ১টি ছোট্ট ঘরে চিতার ছাই ও মৃতের দৈনন্দিন ব্যবহার্য কাপড়-চোপড়, হাড়ি-পাতিল ঘুমানোর চাটাই রেখে দেয়। সৎকারের দিন থেকে ঘরের ঠিক মাঝখানের খুটিতে ১টি বিয়াক্লে বাংনা (বাঁশের নির্মিত থ্রুং) ঝুলিয়ে রাখা হয়। প্রতি বেলা পরিবারের লোকজন তাদের আহারের পর একমুঠো ভাত সেই ঝুলন্ত কাকিয়াতে রেখে দেয়। কারণ খুমীরা বিশ্বাস করে সৎকারে পর মৃতের আত্মা বাড়িতে চলে আসে। এক বছর পর মৃত ব্যক্তির আত্মার উদ্দেশ্যে শেষ ভোজের আয়োজন উপলক্ষে গরু বা শুকর বধ করে পাড়া-প্রতিবেশী ও গোষ্ঠীভূক্ত সকলকে নিমন্ত্রণ করা হয়। ভোজের জন্য জুমে উৎপন্ন সব্জী ও ফসল রান্না করা হয়। এ অনুষ্ঠানে মামাগোত্রীরদের নিমন্ত্রণ করা বাধ্যতামুলক। মদ পরিবেশনের মাধ্যমে ভোজের আয়োজন শেষ করা হয়। খুমী সমাজে কারো অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে সাংসারিক কাজ-কর্ম বন্ধ রাখে। খুমীরা এই আদি নিয়ম আজও পালন করে।

 

খুমী নৃ-জনগোষ্ঠির আদি সংস্কৃতিঃ- খুমী সম্প্রদায়ের আদি সংস্কৃতি ও উৎসবের মধ্যে রয়েছে, সাংগ্রায়, ফ্রাজাং ও আক্যো। তাদের মাতৃভাষায় রচিত বিভিন্ন গান ও আদি যুদ্ধ নৃত্য।